আমারই চেতনার রঙে

 

যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর

ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর!’

-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।

 

আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে; পাখিডাকা ছায়াঢাকা গ্রাম যাকে বলে। আর ছেলেবেলা বলতে দশ বছর বয়েস পর্যন্ত। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটা ঠিক সেভাবে চোখে পড়ে নি সে বয়েসে। তাই যখন শহরে গেলাম পড়তে, গ্রামের সবুজ নয়, বরং গ্রামের মানুষগুলো আর অলস দুপুরের জন্য মন খারাপ হতো। আমার সব সময়েই মনে হয় অলস দুপুর ব্যাপারটা একেবারে গ্রামের নিজের জিনিস। গ্রামের সকাল শুরু হয় শহুরে সকালের অনেক আগে; ঘড়ির কাটায় নয়, মোরগের ডাকে। তাই গ্রামের দিনগুলো হয় লম্বা। শহুরে বাবুরা যতক্ষণে বাস-ট্যাক্সি ঠেঙ্গিয়ে অফিসে গিয়ে পৌঁচ্ছুচ্ছেন, ততক্ষণে গ্রামের কর্মঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। তাই দুপুরের আগেই একপ্রস্থ কাজ শেষ করে জিরিয়ে নেয়া যায়। গ্রামের কাজ দু’বেলা: সকালে আর বিকেলে। আর দুপুরবেলা শুধুই দুপুরবেলা: গোসল, খাওয়া, তারপর গাছের ছায়ায় আড্ডা বা পাটি বিছিয়ে ঘুম। গ্রামে কাউকে বলতে শুনি নিঃ রেখে দে, এ কাজটা দুপুরে করবো। গ্রামের দুপুর মানেই আমার কাছে অলস দুপুর।।

পল্লীর কোল থেকে আলো ঝলমলে শহরে সরে আসা (প্রচলিত অর্থে) একটু ভালো করে বাঁচবার জন্য। অল্প কয়েকজন হয়তোবা আসে জীবনকে আরেকটু ভালো করে বুঝবার জন্য। দশ বছর বয়েসে বেরিয়ে শহরে শহরে কাটিয়ে দিলাম গত বিশটা বছর। যতই সময় পেরুচ্ছে, ততই গ্রামে ফিরে যাবার ইচ্ছে তীব্রতর হচ্ছে: আমার চিরচেনা মল্লিকাবনে। শহরে পূজির মেলা পকেট ভারি করার একটা আশ্বাস দেয় বটে, কিন্তু শহর মনকেও ভারি করে দেয় বড়ো। পূজি নিয়ে কাড়াকাড়ির মধ্যে একটু অলস দুপুর খুঁজে নিয়ে মনের ভেতরে ঘুরে আসার অবসরটুকু শহরে মেলে না। অথচ আমি বিশ্বাস করি সেই মানসিক ভ্রমণেই সুখের নিবাস।।

আমার সবসময়েই মনে হয়েছে সুখের বিস্তার একমুখী: অন্দর থেকে বাহিরে। “পুষ্পবনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে”। বৈষয়িক বৈভব, সম্মান, এমনকি একের পর এক সাফল্যও মনে সুখ আনতে পারে না যদি না সে নিজেকে সুখী মনে করেঃ সুখী হবার সিদ্ধান্ত না নেয়। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও সুখ আসলে একটা মানসিক সিদ্ধান্ত। জাগতিক অর্জনের সাথে আকাঙ্ক্ষা যদি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাহলে সুখ হয়ে থাকে কুহকিনী। আমাদের কী আছে তার উপর সুখের মাত্রা নির্ভর করে না, নির্ভর করে আমরা আরো কতটা চাই তার উপর। তাই যে মুহুর্তে মনের সাথে “আমি সুখী” এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপোষ করা যায়…সেই মুহুর্তেই দশদিকে সুখের বাতাস বইতে শুরু করে। অন্তত আমার অহর্নিশি এমন হয়।

পড়ছিলাম জীবনানন্দের  কবিতা “বলিল অশ্বথ সেই”। কবিতাটি এক অর্থে সাদামাটা; খুব সহজ চিত্রকল্প; অন্তত মহাপৃথিবী পর্যায়ে জীবনানন্দের অন্যান্য কবিতা থেকে বেশ সহজ মনে হয় প্রথম পড়ায়। প্রথম স্তবকটা এরকমঃ

“বলিল অশ্বত্থ ধীরে: ‘কোন দিকে যাবে বলো-

তোমরা কোথায় যেতে চাও?

এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে:

ম্লান খোড়ো ঘরগুলো-আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;

এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের

তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের!

বোঁচকা বেঁধেছ ঢের,-ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও;

আবার কোথায় যেতে চাও?”

সুতরং, শুরুটা একটি অশ্বত্থ গাছের সাথে কথোপকথন দিয়ে।  জীবনানন্দীয় বিচারে খুব একটা অভিনব কিছু নয়। পেঁচা, নক্ষত্র এবং আকাশের সাথে কবির কথোপকথনে আমরা অভ্যস্ত। মনে পড়ে নিরালোক কবিতার কথা

“অনেক নক্ষত্রে ভরে গেছে সন্ধ্যার আকাশ– এই রাতের আকাশ;

এইখানে ফাল্গুনের ছায়া মাখা ঘাসে শুয়ে আছি;

এখন মরণ ভাল,– শরীরে লাগিয়া রবে এই সব ঘাস;

অনেক নক্ষত্র রবে চিরকাল যেন কাছাকাছি।

কে যেন উঠিল হেঁচে,– হামিদের মরখুটে কানা ঘোড়া বুঝি!

সারা দিন গাড়ি টানা হল ঢের,– ছুটি পেয়ে জ্যোৎস্নায় নিজ মনে খেয়ে যায় ঘাস;

যেন কোনো ব্যথা নাই পৃথিবীতে,– আমি কেন তবে মৃত্যু খুঁজি?

‘কেন মৃত্যু খোঁজো তুমি?’– চাপা ঠোঁটে বলে কৌতুকী আকাশ।”

সত্যি বলতে বলিল অশ্বত্থ সেই কবিতার সাথে নিরালোক কবিতার বেশ ভাবগত মিল আছে। দু’টি কবিতাই বলছে নিজের ভেতরের আকংখার আরো গভীর নিশানা বের করতে। অশ্বত্থ গাছটি যেমন প্রশ্ন করছে, “আবার কোথায় যেতে চাও?” আকাশ তেমনি চাপা ঠোঁটে প্রশ্ন করছে, “কেন মৃত্যু খোঁজো তুমি?”

সুতরাং ব্যাপারটা এখানে প্রকৃতির সদা শান্ত-তৃপ্ত বনাম মানবিক সদা অত্রৃপ্ত ্মন্ত্রের। পথপ্রান্তে মহাকালের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি  দেখেছে ঢের…সে জানে মানবের চিরন্তন নিরূপম  যাত্রার আদ্যেপান্ত…

‘পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নিকো-এই-তো সেদিন

তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয়

-আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!-

এখানে মাঠের পারে জমি কিনে খোড়ো ঘর তুলে

এই দেশে এই পথে এই সব ঘাস ধান নিম জামরুলে

জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাঙ্খার বেদনার শুধেছিল ঋণ;

দাঁড়ায়ে-দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যে,-মনে হয় যেন সেই দিন!

‘এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?

সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ?

আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?

তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাঙ্খার ঘর!”

শেষের কয়েকটি পংক্তিতে বিদগ্ধ অশ্বত্থ ঘোষণা করে, এই চলে যাওয়া নিষ্ফল: স্থানাঙ্ক পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষা, জীবনের পিপাসা মিটবে না।

“যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর

ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর!’

-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।”


জীবনের চিরায়ত যে বিপণ্ণ বিস্ময় তার সাথে ভৌগলিক সীমারেখা বা আর্থিক প্রাচুর্যের সম্পর্ক সামান্যই। অশ্বত্থের কাছ থেকে আমরা এর চেয়ে বেশি জ্ঞান কিছু পাই না। তবে নিরালোকের আকাশ আর নক্ষত্র কিন্তু আরো উদার…তারা সমাধান বাতলে দিচ্ছে…


“ঝাউফুলে ঘাস ভরে– এখানে ঝাউয়ের নীচে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে;

কাশ আর চোরকাঁটা ছেড়ে দিয়ে ফড়িং চলিয়া গেছে ঘরে।

সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে কোন্‌ ঘরে যাব!

কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই,- চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে শান্তি আমি পাব?

রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে যাব ?

‘তোমারই নিজের ঘরে চলে যাও’– বলিল নক্ষত্র চুপে হেসে–

‘অথবা ঘাসের ‘পরে শুয়ে থাকো আমার মুখের রূপ ঠায় ভালবেসে;”



সুতরাং সে-ই আবার নিজের কাছে ফিরে আসা। নিজের কাছে, প্রকৃতির কাছে। এদিক দিয়ে মহাপৃথিবীর জীবনানন্দ রাবীন্দ্রিক দর্শনের থেকে হয়ত খুব দূরে ননঃ 

“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শিষের উপরে

একটি শিশিরবিন্দু।”

সপ্তাহান্তের বিরল অবসরে মহাপৃথিবী আর রূপসী বাংলার পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনে হয়, বরিশাল ছেড়ে কলকাতাতে চাকরি খুঁজে বেড়ানো মধ্যবয়েসী জীবনানন্দকে ছেলেবেলার জীবনানন্দ বড্ড উৎপাত করতো। সেই উৎপাতের সারাৎসারে জীবনানন্দের যে উচ্চারণ তা প্রায়শ আমারই মর্মযাতনার  বর্ণরূপ হয়ে কানে বাজে।। 

Posted in ভাবনা, মহাপৃথিবী | 3 টি মন্তব্য

কবি জীবনানন্দের দুর্লভ আলোকচিত্র

কবি জীবনানন্দ দাশের আলোকচিত্র বেশ দুর্লভ। দু’একটার বেশি চোখে পড়ে না সচরাচর। কয়েকটি আলোকচিত্র কবির বন্ধু-পরিচিতজনদের কাছে সংগ্রহ করে কবির জীবনীগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত করেছেন প্রভাতকুমার দাস। ছবিগুলো কবিভক্তদের সাথে শেয়ার করা হলো। ভক্তদের প্রতি অনুরোধ থাকবে বইটি সংগ্রহে রাখার। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত বইটির নামঃ “জীবনানন্দ দাশ”।

JD Mother

কুসুমকুমারী দাশ

Award

নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন পুরষ্কার গ্রহণ

Baba

সত্যানন্দ দাশ

P1

প্রতিকৃতি ১

P2

প্রতিকৃতি ২

P3

প্রতিকৃতি ৩

With LD

লাবণ্য দাশের সঙ্গে

Posted in Uncategorized | 8 টি মন্তব্য

সূর্য নক্ষত্র নারী

 

তোমার নিকট থেকে সর্বদাই বিদায়ের কথা ছিলো

সব চেয়ে আগে; জানি আমি।

সে-দিনও তোমার সাথে মুখ-চেনা হয় নাই।

তুমি যে এ-পৃথিবীতে র’য়ে গেছো।

আমাকে বলেনি কেউ।

কোথাও জলকে ঘিরে পৃথিবীর অফুরান জল

র’য়ে গেছে;-

যে যার নিজের কাজে আছে, এই অনুভবে চ’লে

শিয়রে নিয়ত স্ফীত সুর্যকে চেনে তারা;

আকাশের সপ্রতিভ নক্ষত্রকে চিনে উদীচীর

কোনো জল কী ক’রে অপর জল চিনে নেবে অন্য নির্ঝরের?

তবুও জীবন ছুঁ’য়ে গেলে তুমি;-

আমার চোখের থেকে নিমেষ নিহত

সূর্যকে সরায়ে দিয়ে।

 

স’রে যেতো; তবুও আয়ুর দিন ফুরোবার আগে।

নব-নব সূর্যকে কে নারীর বদলে

ছেড়ে দেয়; কেন দেব? সকল প্রতীতি উৎসবের

চেয়ে তবু বড়ো

স্থিরতর প্রিয় তুমি;- নিঃসূর্য নির্জন

ক’রে দিতে এলে।

মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে আমি যদি মিলিত হতাম

তোমার উৎসের সাথে, তবে আমি অন্য সব প্রেমিকের মতো

বিরাট পৃথিবী আর সুবিশাল সময়কে সেবা ক’রে আত্মস্থ হতাম।

তুমি তা জানো না, তবু, আমি জানি, একবার তোমাকে দেখেছি;-

পিছনের পটভূমিকায় সময়ের

শেষনাগ ছিলো, নেই;- বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা

নিভে যায়;- মানুষ অপরিজ্ঞাত সে-অমায়; তবুও তাদের একজন

গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়!

আহা, তাকে অন্ধকার অনন্তের মতো আমি জেনে নিয়ে, তবু,

অল্পায়ু রঙিন রৌদ্রে মানবের ইতিহাসে কে না জেনে কোথায় চলেছি!

 

দুই

চারিদিকে সৃজনের অন্ধকার র’য়ে গেছে, নারী,

অবতীর্ণ শরীরের অনুভূতি ছাড়া আরো ভালো

কোথাও দ্বিতীয় সূর্য নেই, যা জ্বালালে

তোমার শরীর সব অলোকিত ক’রে দিয়ে স্পষ্ট ক’রে দেবে কোনো কালে

শরীরে যা র’য়ে গেছে।

এই সব ঐশী কাল ভেঙে ফেলে দিয়ে

নতুন সময় গ’ড়ে নিজেকে না গ’ড়ে তবু তুমি

ব্রহ্মাণ্ডের অন্ধকারে একবার জন্মাবার হেতু

অনুভব করেছিলে;-

জন্ম-জন্মান্তের মৃত স্মরণের সাঁকো

তোমার হৃদয় স্পর্শ করে ব’লে আজ

আমাকে ইসারাপাত ক’রে গেলে তারি;-

অপার কালের স্রোত না পেলে কী ক’রে তবু, নারি,

তুচ্ছ, খন্ড, অল্প সময়ের স্বত্ব কাটায়ে অঋণী তোমাকে কাছে পাবে-

তোমার নিবিড় নিজ চোখ এসে নিজের বিষয় নিয়ে যাবে?

সময়ের কক্ষ থেকে দূর কক্ষে চাবি

খুলে ফেলে তুমি অন্য সব মেয়েদের

আত্মঅন্তরঙ্গতার দান

দেখায়ে অনন্তকাল ভেঙ্গে গেলে পরে,

যে-দেশে নক্ষত্র নেই- কোথাও সময় নেই আর-

আমারো হৃদয়ে নেই বিভা-

দেখাবো নিজের হাতে- অবশেষে কী মকরকেতনে প্রতিভা।

 

তিন

তুমি আছো জেনে আমি অন্ধকার ভালো ভেবে যে-অতীত আর

যেই শীত ক্লান্তিহীন কাটায়েছিলাম;

তাই শুধু কাটায়েছি।

কাটায়ে জানেছি এই-ই শূন্যে, তবু হৃদয়ের কাছে ছিল অন্য-কোন নাম।

অন্তহীন অপেক্ষার চেয়ে তবে ভালো

দ্বীপাতীত লক্ষ্যে অবিরাম চ’লে যাওয়া

শোককে স্বীকার ক’রে অবশেষে তবে

নিমেষের শরীরের উজ্জলতায়-অনন্তের জ্ঞানপাপ মুছে দিতে হবে।

আজ এই ধ্বংসমত্ত অন্ধকার ভেদ ক’রে বিদ্যুতের মতো

তুমি যে শরীর নিয়ে র’য়ে গেছো, সেই কথা সময়ের মনে

জানাবার আশার কি একজন পুরুষের নির্জন শরীরে

একটি পলক শুধু- হৃদয়বিহীন সব অপার আলোকবর্ষ ঘিরে?

অধঃপতিত এই অসময়ে কে-বা সেই উপচার পুরুষ মানুষ?-

ভাবি আমি;- জানি আমি,তবু

সে-কথা আমাকে জানাবার

হৃদয় আমার নেই;-

যে-কোনো প্রেমিক আজ এখন আমার

দেহের প্রতিভূ হয়ে নিজের নারীকে নিয়ে পৃথিবীর পথে

একটি মুহূর্তে যদি আমার অনন্ত হয় মহিলার জ্যোতিষ্কজগতে।

Posted in বেলা অবেলা কালবেলা | ১ টি মন্তব্য

যতিহীন

বিকেলবেলা গড়িয়ে গেলে অনেক মেঘের ভিড়

কয়েক ফলা দীর্ঘতম সূর্যকিরণ বুকে

জাগিয়ে তুলে হলুদ নীল কমলা রঙের আলোয়

জ্ব’লে উঠে ঝরে গেল অন্ধকারের মুখে।

যুবারা সব যে যার ঢেউয়ে,-

মেয়েরা সব যে যার প্রিয়ের সাথে

কোথায় আছে জানি না তো;

কোথায় সমাজ, অর্থনীতি? – স্বর্গগামী সিঁড়ি

ভেঙে গিয়ে পায়ের নিচে রক্তনদীর মতো-

মানব ক্রমপরিণতির পথে লিঙ্গশরীরী

হয়ে কি আজ চারিদিকে গণনাহীন ধূসর দেয়াল

ছড়িয়ে আছে যে যার দ্বৈপসাগর দখল ক’রে!

পুরাণপুরুষ, গণমানুষ, নারীপুরুষ, মানবতা, অসংখ্য বিপ্লব

অর্থবিহীন হয়ে গেলে,-তবু আরেক নবীনতর ভোরে

সার্থকতা পাওয়া যাবে ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হ’য়ে

পথে-পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে

তবুও কেবল দ্বীপ বানালো যে যার নিজের অবক্ষয়ের জলে।

প্রাচীন কথা নতুন ক’রে এই পৃথিবীর অনন্ত বোনভায়ে

ভাবছে একা-একা ব’সে

যুদ্ধ রক্ত রিরংসা ভয় কলরোলের ফাঁকেঃ

আমাদের এই আকাশ সাগর আঁধার আলোয় আজ

যে-দোর কঠিন; নেই মনে হয়; সে-দ্বার খুলে দিয়ে

যেতে হবে আবার আলোয় অসার আলোর ব্যসন ছাড়িয়ে।

Posted in বেলা অবেলা কালবেলা | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

সময়সেতুপথে

ভোরের বেলার মাঠ প্রান্তর নীলকন্ঠ পাখি

দুপুরবেলার আকাশে নীল পাহাড় নীলিমা,

সারাটি দিন মীনরৌদ্রমুখর জলের স্বর,-

অনবসিত বাহির-ঘরের ঘরণীর এই সীমা।

 

তবুও রৌদ্র সাগরে নিভে গেল;

ব’লে গেলঃ ‘অনেক মানুষ ম’রে গেছে’; ‘অনেক নারীরা কি

তাদের সাথে হারিয়ে গেছে?’-বলতে গেলাম আমি;

উঁচু গাছের ধূসর হাড়ে চাঁদ না কি সে পাখি

বাতাস আকাশ নক্ষত্র নীড় খুঁজে

ব’সে আছে এই প্রকৃতির পলকে নিবিড় হ’য়ে;

পুরুষনারী হারিয়ে গেছে শষ্প নদীর অমনোনিবেশে,

অমেয় সুসময়ের মতো রয়েছে হৃদয়ে।

Posted in বেলা অবেলা কালবেলা | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

তোমাকে

মাঠের ভিড়ে গাছের ফাঁকে দিনের রৌদ্রে অই;

কুলবধুর বহিরাশ্রয়িতার মতন অনেক উড়ে

হিজল গাছে জামের বনে হলুদপাখির মতো

রূপসাগরের পার থেকে কি পাখনা বাড়িয়ে

বাস্তবিকই রৌদ্র এখন? সত্যিকারের পাখি?

কে যে কোথায় কার হৃদয়ে কখন আঘাত ক’রে।

রৌদ্রবরণ দেখেছিলাম কঠিন সময়-পরিক্রমার পথে-

নারীর,-তবু ভেবেছিলাম বহিঃপ্রকৃতির।

আজকে সে-সব মীনকেতনের সাড়ার মতো, তবু

অন্ধকারের মহাসনাতনের থেকে চেয়ে

আশ্বিনের এই শীত স্বাভাবিক ভোরের বেলা হ’লে

বলেঃ ‘আমি রোদ কি ধূলো পাখি না সেই নারী?’

পাতা পাথর মৃত্যু কাজের ভূকন্দরের থেকে আমি শুনি;

নদী শিশির পাখি বাতাস কথা ব;লে ফুরিয়ে গেলে পরে

শান্ত পরিচ্ছন্নতা এক এই পৃথিবীর প্রাণে

সফল হ’তে গিয়েও তবু বিষণ্নতার মতো।

যদিও পথ আছে-তবু কোলাহলে শূন্য আলিঙ্গনে

নায়ক সাধক রাষ্ট্র সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে;

প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো-

কী বিরাট অবক্ষয়ের মানব-সাগরে।

তবুও তোমায় জেনেছি, নারী, ইতিহাসের শেষে এসেঃ মানবপ্রতিভার

রূঢ়তা ও নিষ্ফলতার অধম অন্ধকারে।

মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালোবেসে

বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।

Posted in বেলা অবেলা কালবেলা, Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

মাঘসংক্রান্তির রাতে

হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে

তোমার পবিত্র অগ্নি জ্বলে।

অমাময়ী নিশি যদি সুজনের শেষ কথা হয়,

আর তার প্রতিবিম্ব হয় যদি মানব-হৃদয়,

তবুও আমার জ্যোতি সৃষ্টির নিবিড় মনোবলে

জ্ব’লে ওঠে সময়ের আকাশের পৃথিবীর মনে;

বুঝিছি ভোরের বেলা রোদে নীলিমায়,

আঁধার অরব রাতে অগণন জ্যোতিষ্ক শিখায়;

মহাবিশ্ব একদিন তমিস্রার মতো হ’য়ে গেলে,

মুখে যা বলোনি, নারি, মনে যা ভেবেছো তার প্রতি

লক্ষ্য রেখে অন্ধকার শক্তি অগ্নি সুবর্ণের মতো

দেহ হবে মন হবে-তুমি হবে সে-সবের জ্যোতি!

Posted in বেলা অবেলা কালবেলা, Uncategorized | ১ টি মন্তব্য

স্থবির যৌবন

তারপর একদিন উজ্জ্বল মৃত্যৃর দূত এসে
কহিবেঃতোমারে চাই- তোমারেই,নারী;
এইসব সোনা রূপা মসলিন যুবাদের ছাড়ি
চ’লে যেতে হবে দূর আবিষ্কারে ভেসে।

বলিলাম;শুনিল সেঃ’তুমি তবু মৃত্যুর দূত নও-তুমি-‘
‘নগর-বন্দর ঢের খুঁজিয়াছি আমি;
তারপর তোমার এই জানালায় থামি
ধোঁয়া সব;-তুমি যেন মরীচিকা-আমি মরুভূমি-‘

শীতের বাতাস নাকে চলে গেলো জানালার দিকে
পড়িল আধেক শাল বুক থেকে খসে
সুন্দর জন্তুর মতো তার দেহকোষে
রক্ত শুধু দেহ শুধু শুধু হরিণীকে

বাঘের বিক্ষোভ বুকে নিয়ে নদীর কিনারে-নিম্নে-রাতে?
তবে তুমি ফিরে যাও ধোঁয়ায় আবার;
উজ্জ্বল মৃত্যুর দূত বিবর্ণ এবার-
বরং নারীকে ছেড়ে কঙ্কালের হাতে
তোমারে তুলিয়া লবে কুয়াশা-ঘোড়ায়।
তুমি এই পৃথিবীর অনাদি স্থবির;-
সোনালি মাছের মতো তবু করে ভিড়
নীল শৈবালের নিচে জলের মায়ায়

প্রেম-স্বপ্ন-পৃথিবীর স্বপ্ন প্রেম তোমার হৃদয়ে।
হে স্থবির, কী চাও বলো তো-
শাদা ডানা কোনো এক সারসের মতো?
হয়তো সে মাংস নয়-এই নারী; তবু মৃত্যু পড়ে নাই আজ তার মোহে।

তাহার ধূসর ঘোড়া চরিতেছে নদীর কিনারে
কোনো এক বিকেলের জাফরান দেশে।
কোকিল কুকুর জ্যেৎস্না ধুলো হয়ে গেছে কত ভেসে?
মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?

Posted in মহাপৃথিবী | 2 টি মন্তব্য

আদিম দেবতারা

আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে
তোমাকে দিলো রূপ-
কী ভয়াবহ নির্জন রূপ তোমাকে দিলো তারা;
তোমার সংস্পর্শের মানুষদের রক্তে দিলো মাছির মতো কামনা৷

আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে
আমাকে দিলো লিপি রচনা করবার আবেগঃ
যেন আমিও আগুন বাতাস জল
যেন তোমাকেও সৃষ্টি করছি।

তোমার মুখের রূপ যেন রক্ত নয়, মাংস নয়, কামনা নয়,
নিশীথ-দেবদারু-দ্বীপ;
কোনো দূর নির্জন নীলাভ দ্বীপ

স্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে তবু
তুমি মাটির পৃথিবীতে হারিয়ে যাচ্ছো;
আমি হারিয়ে যাচ্ছি সুদূর দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়ার ভিতর।

আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে
রূপের বীজ ছড়িয়ে চলে পৃথিবীতে
ছড়িয়ে চলে স্বপ্নের বীজ।
অবাক হয়ে ভাবি
আজ রাতে কোথায় তুমি?
রূপ কেন নির্জন দেবদারু-দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনে না-
পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ?
স্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে- ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –হয়ে
ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –
আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা হো_ হো ক’রে হেসে উঠলোঃ
‘ব্যবহৃত – ব্যবহৃত হ’য়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়?’

হো হো করে হেসে উঠলাম আমি!-
চারিদিককার অট্টহাসির ভিতর একটা বিরাট তিমির মৃতদেহ নিয়ে
অন্ধকার সমুদ্র স্ফীত হ’য়ে উঠলো যেন;
পৃথিবীর সমস্ত রূপ অমেয় তিমির মৃতহেদের দূর্গন্ধের মতো,
যেখানেই যাই আমি সেই সব সমুদ্রের উল্কায় – উল্কায়
কেমন স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক!

Posted in মহাপৃথিবী | ১ টি মন্তব্য

বলিল অশ্বত্থ সেই

বলিল অশ্বত্থ ধীরে: ‘কোন দিকে যাবে বলো-
তোমরা কোথায় যেতে চাও?
এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে:
ম্লান খোড়ো ঘরগুলো-আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;
এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের
তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের!
বোঁচকা বেঁধেছ ঢের,-ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও;
আবার কোথায় যেতে চাও?
‘পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নিকো-এই-তো সেদিন
তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয়
-আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!-
এখানে মাঠের পারে জমি কিনে খোড়ো ঘর তুলে
এই দেশে এই পথে এই সব ঘাস ধান নিম জামরুলে
জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাক্সক্ষার বেদনার শুধেছিল ঋণ;
দাঁড়ায়ে-দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যে,-মনে হয় যেন সেই দিন!
‘এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?
সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ?
আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?
তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাক্সক্ষার ঘর!..
যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাক্সক্ষার ঘর!’
-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।

Posted in মহাপৃথিবী | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান